রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি সাহিত্যকর্মের জায়গা

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য অনেক জায়গায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখ্যযোগ্য অনেক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি এসব জায়গাতেই। তারই মধ্যে একটি শিলাইদহ কুঠিবাড়ি।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি 
জেলা সদর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ি। শিলাইদহের আগে নাম ছিল খোরশেদপুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার গ্রামটি কিনে নেওয়ার আগে এখানে একটি নীলকুঠি ছিল। শেলী নামে একজন নীলকর এটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। গড়াই এবং পদ্মা নদীর মিলিত প্রবাহের ফলে গভীর একটি “দহ” বা ঘূর্ণিস্রোত থেকে গ্রামটির নাম হয় শেলীদহ। পরবর্তীতে তা রূপ নেয় শিলাইদহ-তে। ১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইল সূত্রে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ স্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারির মালিকানা পান। জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে। কৈশোর ও যৌবনের বিভিন্ন সময় জমিদারি দেখাশোনা করতে কবি এখানে আসতেন এবং কুঠিবাড়িতেই থাকতেন। একসময় পদ্মার ভাঙন কুঠিবাড়িকে গ্রাস করার উপক্রম হলে বাড়িটি ভেঙে নতুন কুঠিবাড়ি নির্মাণ করা হয়। ১৮৯১-১৯০১ সালে অল্প বিরতিতে কবি নিয়মিত এখানে অবস'ান করেছেন। শিলাইদহে অভস'ানকালে কবি তার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরষ্কারটি লাভ করেছিলেন। ১৯১৩ সালে কবি যে সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন, সেই “গীতাঞ্জলি”র অধিকাংশ কিবতাই শিলাইদহে রচিত। এ ছাড়াও জাগয়াটিতে বসে বসে তিনি অসংখ্য গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গান ইত্যাদি রচনা করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’, ‘সোনারতরী’, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘বলাকা’, গীতাঞ্জলি’, ‘চিরকুমারসভা’, ‘জীবনস্মৃতি’, ‘পঞ্চভূতের ডায়েরি’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চোখের বালি’ ইত্যাদি। 
সবুজে ঘেরা এ কুঠিবাড়ির প্রবশে পথেই রয়েছে লোহার ফটক। চারপাশ মোটা দেয়ালে ঘেরা। ভেতরে তিনতলা বিশিষ্ট কুঠিবাড়ি। প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ বাড়িটিতে সবমিলিয়ে পনেরটি কক্ষ আছে। তিন তলার একটি ঘরে বসে পদ্মার সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে কবি তার শিল্পকর্ম রচনা করতেন। এখানে রয়েছে বেশ কিছু তৈলচিত্র, কবির ব্যবহৃত লেখার টেবিল, নৌকা, আরামকেদারা, আলমারি, পালকি, ঘাসকাটার যন্ত্র ইত্যাদি। কবি যে নৌকাটিতে চড়ে পদ্মায় ভেসে লিখথেন গল্প-কবিতা সেটিরও ধ্বংসাবশেষ দেখা যাবে কুঠিবাড়িতে। এ ছাড়াও কুঠিবাড়ির পূর্বপাশে আছে কবির আম বাগান, পশ্চিম পাশে শান বাঁধানো পুকুর। 
শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে সরকারি ব্যবস'াপনায় এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাদুঘর। সপ্তাহের রবি ও সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন- খোলা থাকে এ জাদুঘর। সোমবার বেলা ৩টা পর্যন- বন্ধ থাকে। ২৫ বৈশাখ কবির জন্মবার্ষিকী এবং ২২ শ্রাবণ মৃত্যুবার্ষিকীতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় শিলাইদহে। 
যাতায়াত
ঢাকা থেকে সরাসরি সড়কপথে কুষ্টিয়া যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী কল্যাণপুর থেকে বাস যোগে যাওয়া যায়।
শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কাচারিবাড়ি। এখানেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈত্রিক জমিদারি ছিল। কবির দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলকরদের একটি কুঠি নিলামে কিনে নেন। ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে সর্বপ্রথম শাহজাদপুরে জমিদারি তত্ত্বাবধান করতে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপরে ১৮৯৬ সাল পর্যন- জমিদারির কাজে এখানে যাওয়া-আসা ও অবস'ান করেন কবি। এখানে অবস'ানকালে তিনি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগাভাগির ফলে শাহজাদপুরের জমিদারি চলে যায় রবীন্দ্রনাথের অন্য শরীকাদের কাছে। তাই ১৮৯৬ সালে তিনি শাহজাদপুর ছেড়ে চলে যান। জমিদারি খাজনা আদায়ের একটি পুরোনো দ্বিতল ভবন এখনো আছে, বর্তমানে যা ব্যবহৃত হচ্ছে জাদুঘর হিসেবে। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ কবির জন্ম দিবসে এখানে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তিন দিনের নানান অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। 
যাতায়াত
ঢাকার গাবতলী থেকে শাহজাদপুর এক্সপ্রেস সরাসরি যায় শাহজাদপুর। এ ছাড়াও ঢাকার মহাখালী থেকে বাস যোগে যায় সিরাজগঞ্জ। জেলাশহর থেকে রবীন্দ্র কাচারিবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। সেখান থেকে বাসে শাহজাদপুর ষ্টেশনে নেমে এক কিলোমিটার দূরে অবসি'ত কাচারিবাড়ি। 

পতিসর কুঠিবাড়ি
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে আত্রাই উপজেলার পতিসরে নাগর নদীর তীরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেকটি কুঠিবাড়ি। তোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির কালিগ্রাম পরগণার সদর কাচারি ছিল এখানে। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে এ জমিদারি ক্রয় করেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জমিদারি দেখাশুনার জন্য ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম পতিসরে আসেন। পতিসরের দোতলা অনেকটা শিলাইদহ ও  শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ির অনুরূপ। বাড়ির সামনের প্রশ্বস- খোলা মাঠ নাগর নদী পর্যন- বিস-ৃত। ১৯০৫ সালে তিনি পতিসর কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে নোবেল পুরষ্কারের এক লক্ষ টাকাও তিনি এই ব্যাংককে দান করেন। ১৯১৩ সালে কবি পতিসরে প্রতিষ্ঠা করেন কালীগ্রাম রবীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট। বিভিন্ন সমেয় এখানে অবস'ানকালে কবি রচনা করেন তার জীভনের উল্লেখযোগ্য কিছু সাহিত্যকর্ম। ১৯২১ সালে জমিদারি ভাগ হলে পতিসর রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে। কিন' নানান ব্যস-তার কারণে পতিসরের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। শেষ বারের মতো তিনি পতিসরে আসেন ১৯৩৭ সালে। রবীন্দ্র কাচারিবাড়িতে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে কবির অনেক স্মৃতিময় নিদর্শন। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ কবির জন্মদিনে এখানে নানান অনুষ্ঠান এবং লোকজ মেলা চলে আসছে বহু বছর ধরে। 
যাতায়াত
ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি নওগাঁ যাওয়া যায়। নওগাঁ সদর থেকে পতিসর আসা যায় বাসে।